Love, Sufism | সুফিবাদ, ভালোবাসা

ভালোবাসা’র নির্মম রূপ

ভালোবাসা'র নির্মম রূপ

‘ভালোবাসা’ একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং সুন্দর সত্যিকারের প্রকাশ যা মানুষ, প্রাণী তথা সৃষ্টিজগতের সকল স্তরে অত্যন্ত ব্যাপক, শক্তিশালী, আলোকিত এবং প্রতিফলিত একটি রূপ। ভালোবাসার রূপ আবার নির্মম হয় কিভাবে? ভালোবাসা ত বরং পরম আনন্দের এবং তৃপ্তির হবার কথা। হওয়া উচিৎ ও তাই। বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টির ধারা ভালোবাসা এবং প্রেমের নিগুড় বন্ধনে আবিষ্ট। সর্বকালে সর্বক্ষেত্রে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রেম তথা ভালোবাসারই জয় হয়েছে। কেননা আইন কিংবা যুক্তি দিয়ে হয়তো কোন কিছুকে ঠেকানো যায়, দমানো যায়, জেতা যায়, কিন্তু আনন্দ পাওয়া যায়কি? তার মানে জোর জবরদস্তিতে নির্মমতা বা নিষ্ঠরতা থাকতে পারে কিন্তু ভালোবাসায় নির্মমতা কিভাবে থাকে? ভালোবাসা’র বিপরীতে থাকে নির্মমতা কিংবা ঘৃণা। কিন্তু ভালোবাসা’র মধ্যে তা কিভাবে থাকতে পারে!

ধরুণ, আমি বললাম, আমি পাখি খুব ভালোবাসি। পাখি কিনে এনে খাঁচায় আটকে রেখে তাকে নিয়মিত খাবার খাওয়াই, গোসল করাই, হাতে নিয়ে, কোলে নিয়ে আদর করি, চুমা দেই ইত্যাদি। পাখিগুলোকে না দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে। কেউ নিতে চাইলে কিংবা ওদেরকে কেউ বিরক্ত করলে আমি বিরক্ত হই। ওরা অসুস্থ হলে কিংবা মারা গেলে আমার খুবই কষ্ট হয়। তাহলে বুঝা যায় যে, আমি আসলেই পাখি খুব ভালোবাসি। নয় কি! 

কিন্তু একবার ভেবে দেখেছেন কি? পাখিগুলো মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানোর কথা, বিস্তির্ণ চারণভূমি কিংবা শূণে ভেশে বেড়িয়ে নিজের পছন্দে খাবার আহরোনের কথা। অথচ আমার ভাললাগার জন্য, আমার ইচ্ছার বহিপ্রকাশের জন্য আমি তাদেরকে খাঁচায় আটকে রাখি। তাহলে আমি আদতে পাখি নয়, বরং আমার ইচ্ছাটাকেই কি বেশি ভালোবাসি নাই?

একই উদাহরণ অন্য সকল প্রাণীসহ মানুষের বেলায়ও সমানভাবে প্রযোজ্য হতে পারে।

একজন পুরুষ সে তার স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা অর্থাৎ নারীকে অনেক ভালোবাসে। তাকে না দেখলে ভালো লাগেনা, তার কথা শুনতে ভালোলাগে, তাকে স্পর্শ করতে বা পেতে, আলিঙ্গন করতে ভালোলাগে। তার গায়ের গন্ধ, তার হাসি, তার উচ্ছলতা, সবই ভালোলাগে। সে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে তাই তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। সে চেরীফুল পছন্দ করে তাই যত কষ্টই হোক তার জন্য চেরীফুল নিয়ে আসি। সে শপিং করতে ভালোবাসে তাই তাকে নিয়ে শপিং-এ যাই। সে আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে ভালোবাসে তাই তাকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকি। সে অসুস্থ হলে আমার খারাপ লাগে, ইত্যাদি। আবার বিয়ের আগের এবং বিয়ের পরের ঘটনাগুলো অনেক সময়ই ঠিক উল্টোটা ঘটে। কিংবা নারী বা পুরুষ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র হতে দেখা যায়। যেমন ধরুণ, বিয়ের আগে যেই মেয়ের উচ্ছলতা এবং মুক্তমনা দেখে পছন্দ করলেন, বিয়ের পর সেইগুলোই আপনার জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়ালো। আবার পুরুষের বেলায় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো সবই ঠিক আছে, নারীর বেলায় তা বাধা। আপনি যাকে ভালোবাসেন বিয়ের আগে তার ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আর বিয়ের পর আপনার ভালোবাসার মানুষ নয় বরং আপনার ইচ্ছার প্রাধান্য দিচ্ছেন। কিন্তু কেন? কেন এমন হয় ভেবেছেন কি?

অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটা হয় সেটা হলো সে আপনাকে পছন্দ করে তাই আপনি তাকে পছন্দ করেন। সে আপনার জন্য আন্তরিক থাকে তাই আপনি তাকে আপন ভাবেন। সে আপনার সন্তান, পরিবার, আত্মীয় পরিজন, খাবার দাবার, সেবা যত্ন সবই করছে বলে আপনি তাকে পছন্দ করছেন, ভালোবাসছেন। সে আপনার ভালোলাগার এবং আপনার ভেতরের ভালোবাসার ইচ্ছাটাকে প্রশ্রয় দেয় বলে তাকে আপনি এত ভালোবাসেন। সে যদি সারাক্ষণ আপনার ভুল ধরতো, কিংবা দোষারুপ করতো তাহলে কি তাকে আপনার এত ভাল লাগতো? সে যদি আপনার ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে কিংবা আপনার ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে তার ইচ্ছা চাপিয়ে দিত, তাহলে কি আপনি তাকে এত ভালোবাসতেন? অর্থাৎ এখানেও আমরা আসলে আমাদের ইচ্ছাটাকেই ভালোবাসি। 

একইভাবে একজন নারীর বেলায়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।

পছন্দের পুরুষটি যদি তার পছন্দের সবকিছু না এনে দিতো, তাকে প্রাধান্য না দিতো, তার প্রতি যত্নশীল না থাকতো, তার চাহিদা অনুযায়ী অর্থ, সম্পদ, বিলাসিতা, ভ্রমণ, কেনাকাটা এমনকি তার প্রতি আন্তরিক ও খেয়ালি না হত তাহলে সেই নারীকি সেই পুরুষকে ভালোবাসতো? হয়তো কেউ কেউ বাসে নিশ্চয়ই। কিন্তু ব্যতিক্রম ত ব্যতিক্রমই।

ভালোবাসার উপলব্ধি, প্রাপ্তি এবং তৃপ্তি সবই বহাল থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ আপনি আপনার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেন কিংবা আপনার ইচ্ছার যথাযত মর্যাদা পান। আপনার ইচ্ছার বিপরীতে গেলেই দেখবেন সেখানে ভালোবাসা কমতে শুরু করেছে। আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেই সেখানে দন্দ সংঘাত শুরু হয়েছে। উচ্ছাস, উচ্ছলতা, প্রেম ও আনন্দের পরিবর্তে নিরবতা, উদাসীনতা, বিরহ ও বিরক্তি লাগতে শুরু করেছে।

তাহলে চরম সত্য কথাটি হলো আমরা আসলে কাউকেই ভালোবাসিনা বরং নিজেকে ছাড়া। জায়গাটা ভাললাগে মানে জায়গাটিতে আমার ভাললাগার বিষয় আছে। খাবারটি ভালোলাগে মানে সেই খাবারে আমার ভাললাগার বিষয় আছে। মানুষটিকে ভালোলাগে মানে সেই মানুষটি আমার ভালোলাগা, আমার কথা, আমার সময়, আমার অনুভূতি সর্বপুরি আমার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়। আমরা নিজের ভালোলাগা এবং ভালোবাসার বিষয়গুলো আসলে অন্যের উপর চাপিয়ে দেই। তথা আমাদের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেই। আর সেই ইচ্ছার কাঙ্ক্ষিত প্রতিফলন পেলেই আমরা সেই ব্যক্তি, স্থান, বিষয় কিংবা সেই সময়কে ভালোবাসি। মূলত সবই আমার ইচ্ছার প্রতি আমার দাসত্ব। আমি আমার ইচ্ছার কাছে পরাজিত।

আর এই ইচ্ছাটাই শয়তান তথা ডেভিল এর চুড়ান্ত রূপ। এই ইচ্ছাকে দমাতে পারা মানেই প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে থাকা। এই ইচ্ছাকে বিসর্জন দিতে পারাই সৃষ্টিকর্তাকে সেজদা করতে পারা। এই ইচ্ছাকে বিসর্জন দিতে পারাই একজন মানুষের সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারা। এই ইচ্ছাকে দমাতে পারলেই সত্যিকার প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা হয়ে ওঠা। এই ইচ্ছার মৃত্যু মানেই আপনার বেচে থাকতেই মরে যাওয়া। এই ইচ্ছাকে বিনাশ করতে পারলেই আপনার দেহ ত্যাগের পরেও অমর তথা জীবিত হয়ে থাকা। এই ইচ্ছাকে ধংস করতে পারলেই জন্ম চক্র থেকে মুক্ত হতে পারা। এই ইচ্ছাটাই আপনার জীবনের সকল শান্তি, আনন্দ, মুক্তি তথা সকল কিছুর বাধা। এই ইচ্ছার প্রাধান্য দিতে গিয়েই আপনি আপনার জীবনে বয়ে বেড়াচ্ছেন অহঙ্কার, ঘৃণা, মোহ, নেশা, কামনা, লোভ, হিংসা, যন্ত্রণা, দুঃখ, অশান্তি, মিথ্যা এবং নির্মমতা। তাই আমি বা আমরা ভালোবাসি মানে আমরা আমাদের ইচ্ছার নির্মমতাই প্রকাশ করি।

সুতরাং, ভালোবাসার নির্মমতা নয়, ইচ্ছার প্রাধান্য নয়, ভালোবাসি মানে যাকে ভালোবাসি তার ভালোলাগাকে ভালোবাসতে শিখি, ভালোবাসি মানে নিজের ইচ্ছার বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে ভালোবাসি। সর্বোপুরি যিনি পরম যত্নে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অফুরন্ত দিয়েছেন, তার কাছে নিজের ইচ্ছাকে সমর্পন করি। তার ইচ্ছাকে মেনে নেই। আইন কিংবা যুক্তি নয় বরং প্রেম ও ভালোবাসা চিরন্তন সত্য জেনে অন্তরে ধারণ করি। তবেই প্রকৃত ও কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার প্রকাশ ঘটবে।। 

_মামুন চৌধুরী

১৪ই ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

***

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *