Sufism | সুফিবাদ

‘সূফীবাদ আত্মদর্শণের একমাত্র পথ’

নফস কলব শয়তান

আত্মপরিচয় বা আত্মদর্শণ হলো আত্মার দর্শণ। অর্থাৎ আত্মার পরিচয় আগে জানতে হবে। আমরা আত্মা বা রূহ’কে নফস বা প্রাণের সাথে গুলায়ে ফেলি। আত্মা আর নফস এক নয়, একনয় কলব বা অন্তর। আত্মা, প্রাণ এবং কলব প্রতিটা বিষয়ই আলাদা। আর এই আত্মার পরিচয় জানলেই তার সন্ধান এবং স্বাদ দুটোই পাওয়া সহজ হয়। কথা হচ্ছে আত্মার পরিচয় জেনে কি লাভ? আসলে এই পরিচয় না জানা পর্যন্ত এর স্বাদ কি তা জানা কখনোই সম্ভব নয়। আর জানার পরে যা হয় তার তুলনা কোন কিছু দিয়ে বুঝানো সম্ভব নয়। তবে আত্মার পরিচয় জানার অনেকগুলো কারণ আছে, যুক্তি আছে। সহজ কথায়, আপনার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই যে জার্নি, এই জার্নিতে কেবল জন্ম, বেড়ে ওঠা, প্রজনন, বার্ধক্য এবং দেহের অবসান এটাই কি উদ্দেশ্য? নাকি ভিন্ন কিছু! আপনি কোথাও গেলেন আবার ফিরে আসলেন, যাওয়া আসাটাই কি উদ্দেশ্য? নাকি এর মাঝে কিছু করার আছে? নিশ্চয়ই আছে। তা না হলে এমনি এমনি কোথাও গেলাম আবার ফিরে আসলাম এটা যে নেহায়েত মূর্খতা ও আক্কেলহীন কর্ম তা পাগলেও বোঝে।

সুতরাং, এই ভ্রমনের উদ্দেশ্য বা কাজগুলো কি কি, তা জানার জন্য শুরুতেই জানা দরকার আমি নিজে আসলে কে, কোথা থেকে আসলাম, কেন আসলাম আর কেনই বা চলে যাবো? এই জানার মধ্য দিয়ে আপনি আপনার নিজের সত্তাকে চিনতে পারবেন, পাপ, অন্ধকার ও কলুষতা মুক্ত থাকতে পারবেন, জগতে আলো ছড়াতে পারবেন, সর্বদা আনন্দে তথা বেহেশ্ত/জান্নাতে থাকতে পারবেন। অর্থাৎ আমার ভেতরে যে আমি, যে না থাকলে এই দেহের কোনো মূল্য নাই, আবার দেহ ছাড়াও সেই আমির প্রকাশ নাই। এ এক রহস্য! আবার সেই আমি তথা নফস/প্রাণ একা থাকেনা। প্রাণের মধ্যে থাকে অন্তর/মন বা কলব। সেই কলব বা মনের মধ্যে থাকে খান্নাস বা শয়তান। এটা আরো রহস্যময়। কেননা ঐ শয়তানই আপনাকে শান্তিতে থাকতে দেয়না। পবিত্র-কুরআনে বর্ণিত শয়তানের চারটি রূপঃ ইবলিস/অহঙ্কারকারী, খান্নাস/মোহগ্রস্থ/কুমন্ত্রণা , শয়তান/ধোকাবাজ এবং মরদুদ/সম্পদ জমাকারী সহ বহুরূপে আপনার মধ্যে লোভ, হিংসা, অহংকার, ক্রোধ, কাম, মোহ, হিংস্রতা, সার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা এগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে আপনাকে অশান্তি তথা দোযখের আগুনে পুড়াতে থাকে, আপনার অন্তরে সর্বদা পাথরের আঘাত করতে থাকে। আপনি বুঝতেই পারেন না যে, এই মহা জগতে ভ্রমণ করতে এসে আপনি কেনো এসব করছেন? তাহলে প্রাণ আসে প্রাণ যায়, কিন্তু প্রাণ ধংস হয়না, প্রাণের বিনাশ নাই। আর আত্মা হচ্ছে স্বয়ং সৃষ্টি কর্তা, পরম সত্ত্বা, মহাত্মা। যা আদমের মধ্যে ফুতকার করে দেয়া হয়। আর রূহ তথা আত্মা নাযিলের পরই আদমকে সেজদার হুকুম করা হয়। সেই আত্মা, অবিনশ্বর, যার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, ক্ষুধা নাই, ক্লান্তি নাই, ঘুম নাই, বিশ্রাম নাই, শুরু নাই, শেষ নাই; যে এক, অদ্বিতীয়, অনন্ত, অসীম, দেখা যায়না, ধরা যায়না, ছোয়া যায়না, কোথাও নাই আবার সব জায়গায় আছে।। আর নফস বা প্রাণকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন পবিত্ররূপে আমানত স্বরূপ। যাকে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের কর্মের দ্বারা পবিত্র করে আমানতের খেয়ানত করছি।

দেহ ছাড়াও প্রাণের অবস্থান, বিকাশ কোনোটাই সম্ভব না। তাহলে সেই প্রাণটা কি? এই নশ্বর দেহটাই বা কি? দেহ দেখা যায়, ধরা যায়, মাপা যায় কিন্তু প্রাণ/নফস এবং রুহ/আত্মা ধরা যায়না, দেখা যায়না, আটকানো যায়না এমনকি মাপাও যায়না। আবার দেহ মরে যায়, পচে যায়, অবসান হয়। অপর দিকে প্রাণ অবিনশ্বর, আকারহীন স্বত্বা, চিরস্থায়ী। আর রুহ বা আত্মা পরমাত্মার খন্ড পরমানু মহা ব্রহ্মা স্বয়ম্ভূ। যা থাকে সুপ্তরূপে। এই দেহ এবং দেহের মাঝে থাকা প্রাণ, প্রাণের মাঝে মন আর আল্লাহর আদেশ তথা বীজরূপী আত্মাকে জানাই হলো নিজেকে জানা তথা আত্মপরিচয়।

তাহলে আপনার দেহ নামক এই খাচা বা কবরের মাঝে থাকে নফস বা প্রাণ, প্রাণের মাঝে থাকে মন বা অন্তর আর অন্তরের মধ্যে থাকে খান্নাস/শয়তান এবং নিকটেরও নিকটে থাকে রূহ বা আত্মা অর্থাৎ আল্লাহ। কিন্তু আল্লাহ ত শয়তানের সাথে থাকেনা। তবে শয়তান অর্থাৎ আপনার ভেতরের লোভ, হিংসা, অহংকার, ক্রোধ, কাম, মোহ, হিংস্রতা, সার্থপরতা এগুলোকে দমন করে সম্পূর্ণরুপে বিনাশ করে শয়তানকে বিতাড়িত বা আত্মসমর্পন করাতে পারলে বীজরূপী রুহ, তথা আল্লাহ স্বয়ং আপনার মাঝে জাগরিত, প্রকাশিত হয়। তখন আল্লাহ আর আপনার মাঝে কোনো দূরত্ব থাকবেনা। তখন আপনার মাঝেই জান্নাত জাহান্নাম। তখন আপনার ইচ্ছা মানে আল্লাহর ইচ্ছা। অর্থাৎ তখন আপনার হাত, পা, চোখ মুখ অনুভূতি, ইচ্ছা কোনো কিছুই আর আপনার নিজের থাকেনা, সব আল্লাহর হয়ে যায়। আর আল্লাহর হয়ে যাওয়া মানে আপনি আত্মসমর্পণকারী (মুসলমান), মোমিন, ওলি এবং রাসুল। অর্থাৎ যে আল্লাহর কাছে আমরা সবকিছু চাই, সেই আল্লাহই যখন নিজের হয়ে যায়, তখন আপনার আর কোনো কিছুর অভাব থাকেনা। 

*** 

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *